প্র শহর তার বিচিত্র শব্দ যথাযথভাবে ধরে রেখেছে। একটি আদিশহরের পুরনো ধ্যানেই আছে আমার তিলোত্তমা ঢাকা। এখানে সড়কে নানাগতির বিচিত্র যানবাহন। এই শহরে কেউ নতুন এলে মনে করবেন, কোনো একটি সড়ক মিউজিয়ামে এসে পড়েছেন। শহরে প্রতিদিনই কিছু না কিছু মানুষ যুক্ত হচ্ছেন। মধ্যরাতের পর সড়ক কিছুটা স্বস্তি পায়, তারপর জিরিয়ে নেয়। মাত্র ৪ ঘণ্টা পরই আবার জেগে ওঠে। ছোট-বড় সব সড়কে যেমন সববয়সী মানুষের ভিড়, তেমনি সব ধরনের যানবাহনেরও দেখা মেলে। আশির দশকের মিশুক কেবল নেই। আর না হয় সবই আছে। সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। সেই অটোরিকশার যে কত ধরনের সাইজ এবং ডিজাইন, তা আরেক অনন্য শিল্পশৈলীর নিদর্শন বহন করছে। একদিন মালিবাগ থেকে এক ব্যাটারি রিকশায় চড়ে নীলক্ষেত হয়ে জিগাতলা এবং ট্যানারির মোড় পর্যন্ত গেলাম। গুনে দেখলাম, অন্ততপক্ষে ১২ ধরনের ব্যাটারি রিকশা। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো- ছয় সদস্য থেকে তিন সদস্য পর্যন্ত নিজের নিজের চাহিদা অনুযায়ী পছন্দের ব্যাটারি রিকশায় উঠছেন। গল্প করতে করতে আরামে জিনিসপত্র নিয়ে এসব রিকশায় উঠছেন তারা।
প্রতিদিন শহরের মানুষের চাহিদার জোগান দিতে গণপরিবহন যেন কোথায় একটা বৈরী আচরণ করেই যাচ্ছে। কিন্তু জীবন তো থেমে থাকে না। পায়ে হেঁটে, চাকা, সাইকেল থেকে রূপান্তরবাদের এই গল্প পৃথিবীর শুরুর দিন থেকে। যাই হোক, এখন নগরীর যানবাহনের মধ্যে আলোচনায় এগিয়ে ব্যাটারি রিকশা। কোনোটি প্যাডেল চালিত রিকশার মতো হলেও সুড়ৎসাড়ুত করে ৩০ কিলোমিটার গতিতে বেরিয়ে যায়। প্যাডেলচালিত রিকশাওয়ালাদের খিস্তিখেউর, বড় রাস্তায় উঠলে ট্রাফিকের ঝামেলা ফলে ব্যাটারি রিকশা এখন সবচেয়ে সহজলভ্য। সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গণপরিবহন মালিক, ভোক্তা অধিকার সংগঠনসহ পরিবহন নিয়ে কাজ করা সবকটি সংস্থার আলোচনার মূলে রয়েছে, এই ব্যাটারি রিকশা। এর আপদ, বিপদ নিয়েই সব আলোচনা। কিন্তু এর স্বস্তি নিয়ে কোনো কথা নেই। তবে নগরবাসীর স্বস্তির কথা ভেবে এখন ব্যাটারি রিকশাকে শহরের জনপ্রিয় যানবাহন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সময় হয়েছে বলে আমি মনে করি। প্যাডেলের রিকশাগুলোকে মুক্তি দেওয়া উচিত। তবে এর জন্য বড় পরিকল্পনা দরকার। বিশৃঙ্খলা এড়াতে এজন্য পৃথক লেন জরুরি। এর সংখ্যা ঠিক করা। চালকদের রাস্তাঘাট সম্পর্কে মোটিভেশনাল প্রোগ্রাম নেওয়া এসব।
ব্যাটারি কেন স্বস্তি দিয়েছে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের এর কিছু চাক্ষুষ নজির তুলে ধরলাম : ১. এবারের ঈদুল ফিতরের আগে রমজানে ব্যাটারি রিকশা যেমন কেনাকাটার আরেকটি বড় অংশ হয়ে গিয়েছিল। মার্কেটগুলোর সামনে সিএনজি অটোরিকশা, রিকশা, অটো, উবারের প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল জড়ো হয়ে আছে। কেনাকাটা করে ঘেমে নেয়ে এখন শুধ্ ুগন্তব্যে যাওয়ার চিন্তা। কোথায় যাবেন বলে এসব পরিবহনের চালকরা ঘিরে ধরছেন। আমি মৌচাক থেকে নন্দীপাড়া যাওয়া এক পরিবারকে দেখলাম। তারা চারজন বড় ৭/৮ বছরের দুই শিশু। প্যাডেল রিকশা একটা সম্ভব নয়। দুইটা ২শ করে ৪শ টাকা হাঁকল। সিএনজি অটোরিকশাও লাগবে দুইটা। ভাড়া সাড়ে ৪শ। মোটরবাইক তো একজনের জন্য শুরুতেই বাদ। জ্যামের কারণে ওই রাস্তায় উবারের প্রাইভেট সম্ভব নয়। আছে নানা সাইজের ব্যাটারি রিকশা। বড় সাইজের একটা ব্যাটারি রিকশা ভাড়া করলেন পরিবারের কর্তা। দেড়শ টাকা। পেছনে তিনজন বসলেন। সামনের সিটে এক কিশোর ও এক ভদ্রলোক। আর শিশুটি পেছনে একজনের কোলে বসল। সবাই একসঙ্গে কেনাকাটার আনন্দ উপভোগ করতে করতে চলে গেলেন। এই দৃশ্য এখন হরহামেশা। ২. সকালে স্কুলে যাওয়ার সময় এবং স্কুল থেকে ফেরার সময় দেখা যায়, মা তার স্কুলগামী দুই সন্তানকে নিয়ে আরামে ব্যাগ রেখে ছুটছেন। কখনো কখনো দুই অভিভাবক এক অটোতে দুই বাচ্চা ও ব্যাগ এবং সঙ্গে কিছু কেনাকাটা করে আরামে বসে চলেছেন। প্রতিদিন এই দৃশ্য আমাদের সবার চোখে পড়ে। প্যাডেল রিকশায় আসলে দুই জনের বেশি নিরাপদ নন। আর সময়ও বাঁচে। বাচ্চারা আরামে উঠতে পারে। ৩. নিম্ন মধ্যবিত্তদের, বয়োজ্যেষ্ঠদের কোথাও যাওয়া, কারও বাড়িতে কিংবা চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার বিষয়টা অনেক সময় যানবাহনের কারণে কঠিন হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে সিএনজি অটোরিকশা খারাপ নয়। তবে তিনজনের বেশি হলে আর হয় না। আর রিকশায় উঠতে বেশ কষ্ট হয় জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের জন্য। এছাড়া ব্যাটারির রিকশা, একটু খোলামেলা। উঠতে সুবিধা। চারজন আরামে যেতে পারেন। ভাড়াও নিম্ন মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যে। ৪. মানবিক দিক বিবেচনা যদি করি, এই গরমে রাস্তায় প্রায়ই দেখি সবধরনের যান চলছে। এরমধ্যে প্যাডেলচালিত রিকশাচালককে দেখি গরমে দিশাহারা। শরীর ঘেমে চুপচুপে হয়ে গেছে। রাস্তার পাশ থেকে পানি কিনে খাচ্ছে। ৩৫ বছরের এক রিকশাচালককে দেখে মনে হবে ৫০-এর ঘরে। সারা দুনিয়ায় তো এই ধরনের অপ্রাসঙ্গিক শ্রমকে না করছে মোটরচালিত যান। তাহলে আমরা কেন? তিনটি খ্যাপ মেরে গাছের তলায় বা একটু ছায়ায় যখন রিকশাচালকরা জিরিয়ে নেন আর তখন ব্যাটারি রিকশার চালক তার নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা অনুযায়ী, কিছুটা কম কায়িকশ্রমে কাজ করে ঘরে ফেরেন। আর রিকশাচালক শরীরের ওপর জবরদস্তি করে ঘরে ফেরেন। সবমিলিয়ে ঢাকা শহর পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ মহানগর। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ এই শহরে প্রবেশ করছেন জীবিকার সন্ধানে, চিকিৎসা ও শিক্ষার প্রয়োজনে। সড়ক অবকাঠামো অপর্যাপ্ত, গণপরিবহনের অবস্থা করুণ। এ অবস্থায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বা ইজিবাইক হয়ে উঠেছে নগরবাসীর চলাচলের বিকল্প ভরসা। বিশেষ করে পাড়া-মহল্লা, বাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালের সংযোগে এই বাহনগুলো এক অনিবার্য বাস্তবতা। নারী, শিশু, বৃদ্ধ, গার্মেন্টস কর্মীসহ নানা শ্রেণির মানুষের কাছে এটি একটি সহজলভ্য এবং তুলনামূলক নিরাপদ বাহন। তবে এই স্বস্তির যান যখন আইন ও ব্যবস্থাপনার বাইরে চলে যায়, তখন তা নৈরাজ্য সৃষ্টি করে। রিকশার গায়ে ব্যাটারি লাগিয়ে স্বল্প খরচে উচ্চগতি নিশ্চিত করা গেলেও এগুলোর ব্রেকিং সিস্টেম, ভারসাম্য বা সড়কযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। অধিকাংশ চালক প্রশিক্ষণহীন, ট্রাফিক সিগন্যাল বা লেনের কোনো নিয়ম মানেন না। ফলে ট্রাফিক জ্যাম বাড়ে, দুর্ঘটনার আশঙ্কা বাড়ে এবং সার্বিক সড়ক পরিবেশ নষ্ট হয়। তাছাড়া, এদের চার্জিংয়ের জন্য গ্রিড থেকে প্রচুর বিদ্যুৎ খরচ হয় এবং ব্যবহৃত সিসা-অ্যাসিড ব্যাটারিগুলো অপরিকল্পিতভাবে নিষ্কাশন হওয়ায় মারাত্মক সিসাদূষণ হচ্ছে।
বুয়েটের গবেষণা অনুযায়ী, এসব ব্যাটারি রিকশা চার্জ করতে প্রতিদিন প্রায় ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ অপচয় হচ্ছে এবং ৮০ শতাংশ ব্যাটারি পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ হচ্ছে অবৈধভাবে। অন্যদিকে, এই রিকশার সঙ্গে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত। হঠাৎ নিষিদ্ধ করলে কর্মসংস্থানহীনতা, সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও বিক্ষোভ দেখা দিতে পারে যেমন দেখা গেছে ২০২৪ সালের হাইকোর্ট নিষেধাজ্ঞার পরে। তাই এই ইস্যুতে প্রয়োজন সুসংহত ও মানবিক নীতিমালা।
বর্তমান নীতিমালার সার-সংক্ষেপ : ২০১৪ সালে হাইকোর্ট ব্যাটারিচালিত রিকশা নিষিদ্ধ করে এবং ২০২১ সালেও এদের আমদানি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে হাইকোর্ট পুনরায় এই রিকশা বন্ধের নির্দেশ দিলে জনরোষ তৈরি হয় এবং সরকারের আপিলের ফলে আপিল বিভাগ স্থগিতাদেশ জারি করে। বর্তমানে প্রশাসন সীমিতভাবে এই রিকশা চলতে দিচ্ছে এবং একটি নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বুয়েটের প্রস্তাবিত মডেল রিকশাকে ভিত্তি করে মান নির্ধারণ এবং সীমিত এলাকায় বৈধতার পরিকল্পনা চলছে।
সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর ভূমিকা : ঢাকা সিটি করপোরেশন : ডিএসসিসি ব্যাটারিচালিত রিকশা নিষিদ্ধ করে প্যাডেলচালিত রিকশা পুনর্নিবন্ধন চালু করেছে। ডিএনসিসি প্রধান সড়কে রিকশা নিষিদ্ধ রেখেছে এবং গলিপথে সীমিত অনুমতির কথা বিবেচনা করছে। বুয়েটের স্ট্যান্ডার্ড রিকশা মডেল গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে। বিআরটিএ : এই রিকশার নিবন্ধন দেয় না কারণ আইনত এগুলোর স্বীকৃতি নেই। সরকার আইন সংশোধনের মাধ্যমে সিটি করপোরেশনকে নিবন্ধন ক্ষমতা দিতে চায়। ডিটিসিএ ও ডিএমপি : ডিটিসিএ প্রধান সড়কে এসব রিকশা না রাখতে সুপারিশ করেছে। ডিএমপি মালিকানা সীমিতকরণ, রাতের অভিযান এবং চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট ভাঙার পরিকল্পনায় রয়েছে।
কোন এলাকায় বৈধ বা অবৈধ : প্রধান সড়ক/মহাসড়ক : সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। গলি/অভ্যন্তরীণ রাস্তা : বাস্তবে চলছে, আইনত বৈধ না হলেও প্রশাসন সহনশীল। ঢাকার বাইরে শহরতলি ও উপজেলা : অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলছে, কার্যত বৈধ। জাতীয় মহাসড়ক : একেবারে নিষিদ্ধ, আইনের আওতায় অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত। সরকারের অবস্থান : সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ নয়, বরং নিয়মতান্ত্রিক বৈধতার কাঠামো গড়ার উদ্যোগ। নিবন্ধন, প্রশিক্ষণ, নকশা উন্নয়ন ও চার্জিং নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ। সিসা-অ্যাসিড ব্যাটারির কারণে পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা। নিরাপত্তার জন্য বুয়েট-নির্ধারিত নকশা ও স্পিড লিমিটার প্রবর্তনের পরিকল্পনা। গণমাধ্যমে সাম্প্রতিক প্রতিবেদন ও বিতর্ক : হাইকোর্টের আদেশে তিন দিনের মধ্যে রিকশা বন্ধের নির্দেশে বিক্ষোভ ও জনভোগান্তি সৃষ্টি হয়। আপিল বিভাগ স্থগিতাদেশ দিলে রিকশা আবার চলে। গণমাধ্যমে চাঁদাবাজি, অনিয়ম, পুলিশের মদদ এবং রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রিকশা নিষিদ্ধ নয়, বরং সুশৃঙ্খলীকরণই সমাধান। হঠাৎ করেই রাজধানী ঢাকার সড়কে বেপরোয়া হয়ে উঠছে ব্যাটারিচালিত রিকশা (অটোরিকশা)। আগে অলিগলিতে দাপট থাকলেও তা এখন রাজধানীর মূল সড়কে। বড় যানবাহনের সঙ্গে প্রতিনিয়ত পাল্লা দিয়ে চলা এসব অটোরিকশার কারণে বেড়েছে দুর্ঘটনা। ঢাকায় গত দেড় মাসে অর্থাৎ আগস্ট মাস থেকে অটোরিকশা বেড়েছে ৪ লাখ। এ নিয়ে ঢাকার অলিগলিসহ মূল সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ৬ লাখের বেশি অটোরিকশা। ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা বর্তমানে একটি জটিল সামাজিক, প্রশাসনিক ও পরিবেশগত ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। একদিকে জনসাধারণের চলাচলের সহজ উপায়, অন্যদিকে নিয়ন্ত্রণহীনতায় দুর্যোগ। সরকার একটি নীতিমালার খসড়া তৈরি করে নৈরাজ্য থেকে সুশৃঙ্খল ব্যবস্থার দিকে যাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে দীর্ঘদিনের বিতর্কের অবসান ঘটবে বলেই আশা করা যায়। নাগরিক স্বস্তি ও সড়ক নিরাপত্তার মধ্যে ভারসাম্যই হবে টেকসই সমাধান।
লেখক:
উম্মুল ওয়ারা সুইটি
সাংবাদিক
ummulwarasweety@gmail.com